লায়ন ডা. বরুণ কুমার আচার্যঃ হাজার বছরের পুরানো ধর্মীয় ঐতিহ্যবাহী ও সনাতনী সম্প্রদায়ের কাছে অতিপবিত্র মন্দাকিনী মহাতীর্থ। এই তীর্থে স্নানের মাধ্যমে নিজ নিজ পাপ-তাপ বিসর্জন দিয়ে সনাতনী নর-নারী পাপ ও শাপ মুক্ত হন। এই লক্ষ্যে প্রতিবছর সনাতন, ত্রিপুরা, চাকমা, মারমা নৃগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন ধর্ম গোত্রের মানুষ মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে এখানে সমবেত হন। ইহকাল ও পরকালের শান্তি অন্বেষণে এখানে সমবেত হয়ে ধর্মীয় কার্যাদি সম্পন্ন করেন।
চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের মন্দাকিনী গ্রামে এই মহাপুণ্যস্থানে মন্দাকিনী নদী ও শিব মন্দির অবস্থিত। সেই নদীর নামে গ্রামটির নামকরণ। মৈনাক পর্বতের চন্দ্রনাথধামের পাদদেশ থেকে উত্তরমুখী প্রবাহিত এই খরস্রোতা নদী হালদা নদীতে বিলীন হয়েছে। মহাভারতের ভগীরত গঙ্গা আনায়ন পর্বের বর্ণমাতে: ভগরীতের সাধনায় তুষ্ট হয়ে মা গঙ্গা যখন শিবের জঠর থেকে মর্ত্যলোকের উদ্দেশ্যে ত্রিধারায় পতিত হয়, তখন গঙ্গার তিনটি ধারা ত্রিলোকের দিকে ধাবমান হয়। মর্ত্যলোকে গঙ্গা, পাতাললোকে অলকানন্দা, স্বর্গালোকে মন্দাকিনী নামে। যা সব গঙ্গারই রূপ। সেই গঙ্গাজলের পরশে মর্ত্যলোকে ভগীরতের ১৬ হাজার জাতি ও পূর্বপুরুষ অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে স্বর্গে গিয়েছিলেন। প্রশ্ন জাগে স্বাভাবিকভাবে যে, স্বর্গলোকে প্রবাহমান মন্দাকিনী কেন মর্ত্যলোকে?
একদা মাতা অন্নপূর্ণা কর্তৃক অভিশপ্ত হয় ব্যাসদেব। সেই অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মাতা অন্নপূর্ণার পরামর্শে ব্যাসদেব মৈনাক পর্বতে চন্দ্রনাথ রূপে স্থিত মহাদেবের সাধনা করতে আসেন। চন্দ্রনাথ রূপে মহাদেবের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। তিনি অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে পর্বতের পাদদেশে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে পিন্ডদান করেন। পিন্ডদানে পানির প্রয়োজনে ব্যাসকুন্ডু দিব্যদৃষ্টির মাধ্যমে সেখানে কূপ সৃষ্টি করেন। এখনো চন্দ্রনাথ ধামের পাদদেশে ব্যাসকাডু নামে পরিচিত এবং দৃশ্যমান। ব্যাসদেব তপস্যায় সিদ্ধিলাভ, অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া এবং পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাযজ্ঞ ইত্যাদি সম্পন্ন করার পর উৎফুল্লচিত্তে ভ্রমণে বাহির হলে মৈনাক পর্বতের পূর্বপার্শ্বে আসতেই ছোট, খরস্রোতা ও উত্তরদিকে প্রবাহমান নদী দেখতে পান। তিনি ধ্যান যোগে এই নদীর ইতিবৃত্ত জেনে যান। তিনি নিশ্চিত হন যে এই প্রবাহমান নদী স্বর্গের মন্দাকিনী, যা মর্ত্যলোকে গঙ্গা নদী নামে প্রবাহমান। তাই পুত-পবিত্র এই নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে এর নিবৃত্তি স্থল দেখতে ব্যাসদেব সর্বশেষ প্রাপ্ত পর্যন্ত আসেন। অর্থাৎ বর্তমান মন্দাকিনী গ্রামের শেষভাগে।
আরও পড়ুন মন্দাকিনী মহাতীর্থ পরিচালনা পরিষদের সভা
ব্যাসদেব এই নদীর গুরুত্ব জেনে পবিত্র এই নদীতে স্নান ও তর্পণ করে তীর্থের নিয়ম অনুসারে এখানে নদীতটে রাত যাপন করেন। সেই দিনটি ছিল মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী। তখন থেকে অধ্যাবধি চৈত্রমাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে এই মন্দাকিনী নদীতে স্নানের প্রচলন হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দশদিন ব্যাপী বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও মেলা হতো। বর্তমানে ২/৩ দিন অনুষ্ঠান হয়। মন্দাকিনীতে বহুপ্রাচীন শিব মন্দিরটি এখন নতুনভাবে সংস্কার করে শিব বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। তীর্থযাত্রীদের স্নানের সুবিধার জন্য পাকাঘাট নির্মিত হয়েছে। রাস্তা কার্পেটিং করে সরাসরি মন্দির পর্যন্ত গাড়ি যাতায়াতের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বর্তমান পরিচালনা পরিষদের ব্যবস্থাপনায় সনাতনী সম্প্রদায়ের বিত্তশালী লোকজনের সহায়তায় এবং সরকারি সহায়তায় বর্তমানে মন্দাকিনীতে বহু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে এবং অনেক কাজ চলমান রহিয়াছে।
এছাড়া প্রতিবছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান সূচির মধ্যে উল্লেখযোগ্য- শ্রীশ্রী শিব ও গঙ্গাপূজা, শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠ, কাটিরহাট লোকনাথ সেবাশ্রমের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ উজ্জ্বলানন্দ ব্রক্ষ্মচারীর পৌরহিত্যে বিশ্বশান্তি শ্রীশ্রী গীতাযজ্ঞ, মন্দাকিনী স্নান ও তর্পন, মহাপ্রসাদ আস্বাদন, দেশবরেণ্য ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে সনাতন ধর্ম মহাসম্মেলন, কবিয়াল শ্রী নিরঞ্জন ঘোষ ও কবিয়াল শ্রী সঞ্জয় গান্ধীর অংশগ্রহণে কবিগান। ৫ ও ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠানসূচির মধ্যে রয়েছে, মন্দাকিনী স্নান ও তর্পন, শ্রীশ্রী শিব পূজা, শ্রীপাদ গঙ্গাপদ গোস্বামী ও বাগীশিক হাটহাজারী উপজেলা সংসদের পরিবেশনায় শ্রীমদ্ভগবদগীতাপাঠ,
মহাপ্রসাদ আস্বাদন।
মন্দাকিনী মহাতীর্থ পরিচালনা পরিষদের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে স্ববান্ধবে, স্বপরিজনে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ ও অনুরোধ জানাই।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, মরমী গবেষক। প্রচার সম্পাদক, মন্দাকিনী মহাতীর্থ পরিচালনা পরিষদ।
Leave a Reply